মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের প্রথম মেয়াদে টিকটক নিষিদ্ধে নেওয়া উদ্যোগের নেতৃত্বে ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে সেই তিনিই এবার ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপটির ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত হলেন। যদিও টিকটককে একেবারে স্বস্তি না দিয়ে একটা প্যাঁচ রেখে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

স্থানীয় সময় সোমবার (২০ জানুয়ারি) শপথ নেওয়ার পর টিকটক নিষেধাজ্ঞার আইন কার্যকরে আরও ৭৫ দিন বিলম্ব করতে একটি নির্বাহী আদেশে সই করেন তিনি।

তবে অ্যাপটি যুক্তরাষ্ট্রে সচল রাখতে হলে দেশটির সরকারকে অর্ধেক মালিকানা দিতে হবে বলেও এ সময় আভাস দিয়েছেন ট্রাম্প।

শুধু তাই নয়, চীনকে হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘টিকটকের সঙ্গে মার্কিন চুক্তির অনুমোদন দিতে বেইজিং যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে দেশটির বিরুদ্ধে নতুন করে রাজস্ব আরোপ করা হবে।’

জনপ্রিয় অ্যাপটি নিষিদ্ধের আইন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট বহাল রাখায় শনিবার (১৮ জানুয়ারি) দিনের শেষভাগে অ্যাপল ও গুগলসহ মার্কিন অ্যাপ স্টোর থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় টিকটক।

তখন এক বার্তায় টিকটক জানায়, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে টিকটিক নিষিদ্ধ করে যুক্তরাষ্ট্রে একটি আইন কার্যকর করা হয়েছে। যে কারণে এখন থেকে ব্যবহারকারীরা আর অ্যাপটিতে ঢুকতে পারবেন না।’

কিন্তু পরের দিনই আবার অ্যাপ স্টোরে দেখা দেয় টিকটক। পরে রবিবার (১৯ জানুয়ারি) রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে ট্রাম্প বলেন, ‘টিকটক ফিরেছে, আমাদের হাতে এটির কোনো বিকল্প নেই।’

আরও পড়ুন: টিকটক বন্ধ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে!

খবরে বলা হয়, এই নিষেধাজ্ঞা অস্থায়ী হলেও এতে যুক্তরাষ্ট্রের ঘরোয়া রাজনীতি, সামাজিকমাধ্যমের বাজার, চীন-মার্কিন সম্পর্ক ও লাখ লাখ টিকটক ব্যবহারকারীর ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের ১৭ কোটি বাসিন্দা টিকটক ব্যবহার করেন। সাংস্কৃতিক ও আর্থিকভাবে তারা এই অ্যাপটির ওপর নির্ভরশীল।

মার্কিন তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অ্যাপটির জনপ্রিয়তা অস্বাভাবিক। তারা খবরাখবর পেতে, বিনোদন ও অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে দিনের বড় একটা সময় টিকটকে ডুবে থাকেন।

এর আগে কখনও যুক্তরাষ্ট্রে কোনো সামাজিকমাধ্যম নিষিদ্ধ করা হয়নি। গত বছরের এপ্রিলে কংগ্রেসে দ্বিদলীয় ভোটে পাস হয় আইনটি। গত শুক্রবার মার্কিন সুপ্রিম কোর্টও আইনটিকে বহাল রাখে। এতে চীনা মালিকানার অন্য অ্যাপগুলোও নিষিদ্ধ কিংবা বিক্রি করতে বাধ্য করতে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয় ট্রাম্প প্রশাসনকে।

তবে তারা আইনটিকে একতরফাভাবে ব্যবহার করবে কিনা, তা এখনও পরিষ্কার নয়। কিন্তু ট্রাম্পের আগের মেয়াদে সামাজিকমাধ্যম, জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রযুক্তি নিয়ে নাটকীয় যেসব বিতর্ক উঠেছিল, টিকটকের ঘটনা এবার সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।

টিকটক ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপ স্টোর থেকে ভিডিও সম্পাদনার অ্যাপ ক্যাপকাট, লাইফস্টাইল অ্যাপ লেমন৮ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।

হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার আগে নিজের সামাজিকমাধ্যম টুথ সোশ্যালে ট্রাম্প বলেন, ‘টিকটক নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে সময় বাড়াতে চাই যাতে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তায় তাদের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে পারি।’

এর আগে তিনি বলেছিলেন, শপথ নেওয়ার পর টিকটককে নব্বই দিন সময় দিতে চান তিনি। আর সেটার  সিদ্ধান্ত সোমবার চূড়ান্ত করা হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশকিছু সামাজিকমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনি প্রচারেও তা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিল।

চীনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ বিল বিশপ বলেন, ‘টিকটক নিয়ে মার্কিন ঘরোয়া রাজনীতিও তোলপাড়। কিন্তু এখন পর্যন্ত যা কিছু ঘটছে, সবই ট্রাম্পের অনুকূলে।’

‘যদি আইন কার্যকর হয়ে টিকটক বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ওপর সেই দায় চাপাবেন তিনি। কারণ বাইডেন প্রশাসনের অধীনেই আইনটি প্রণয়ন হয়েছে। আবার যদি টিকটক ফিরে আসে, তাহলে ট্রাম্প হবেন ত্রাতা। সামাজিকমাধ্যম ও ব্যবহারকারী—দুপক্ষ থেকে প্রশংসায় ভাসবেন ট্রাম্প।’

ট্রাম্পের আনুকূল্য পেতে ব্যস্ত টেক জায়ান্টরাও

টিকটক নিষিদ্ধ ও পুনর্বহাল করার ঘটনা এমন একটি সময় ঘটেছে, যখন বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানি ও প্রধান নির্বাহীরা অধীর আগ্রহে ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করছেন।

ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারে ২০ কোটি ডলার খরচ করে তার সঙ্গে নজিরবিহীন সম্পর্ক উপভোগ করছেন টেসলার প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্ক। নিজে মাঠে নেমে ট্রাম্পের জন্য ভোট চেয়েছেন সামাজিকমাধ্যম এক্সের মালিক।

এছাড়া, ফ্লোরিডার মার-আ-লাগো রিসোর্টে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম এই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করেন মেটার প্রধান নির্বাহী মার্ক জুকারবার্গ। এখানেই ক্ষান্ত হননি ফেসবুকের এই সহ-প্রতিষ্ঠাতা। ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সম্প্রতি নিজের সামাজিকমাধ্যমগুলোর নীতিমালাতেও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছেন তিনি।

সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে চলতি মাসের শুরুতে মেটার সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে তৃতীয় পক্ষের ফ্যাক্ট-চেকিং বন্ধ করে দিয়েছেন জুকারবার্গ। পাশাপাশি বিদ্বেষ প্রচার নিয়ন্ত্রণে যে নীতিমালা ছিল, তা-ও শিথিল করা হয়েছে। বৈচিত্র্য ও ন্যায্যতার নীতিমালারও ইতি টেনেছেন এই প্রযুক্তিবিদ।

এ ছাড়াও, আল্টিমেট ফাইটিং চ্যাম্পিয়নশিপের (ইউএফসি) প্রধান নির্বাহী ও প্রেসিডেন্ট ডানা হোয়াইটকে মেটার পরিচালনা বোর্ডে নেওয়া হয়েছে। ট্রাম্পের প্রভাবশালী মিত্র হিসেবে দেখা হয় হোয়াইটকে।

ট্রাম্পের সান্নিধ্য পেতে তার অভিষেক তহবিলে ১০ কোটি ডলার করে সহায়তা দিয়েছেন ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অ্যাল্টম্যানসহ অ্যামাজন, মেটা ও গুগল। পাশাপাশি নিজেদের প্ল্যাটফর্মের নীতিমালায়ও পরিবর্তন এনেছেন তারা।

একইভাবে ট্রাম্পের আনুকূল্য পাওয়ার চেষ্টা করছেন টিকটকের প্রধান নির্বাহী শু চু। গত ডিসেম্বরে তিনি মার-আ-লাগোতে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন। এমনকি ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ওয়াশিংটনে এসে হাজির হন শু চু।

আরও পড়ুন: অনিশ্চয়তা কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরেছে টিকটক

টিকটক নিষিদ্ধে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের রায় সম্পর্কে জানতে জাইলে সতর্কভাবে ট্রাম্পের তারিফ করেন তিনি। অ্যাপটির ভাগ্যও তার ওপর ছেড়ে দিয়ে শু চু বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক চালু রাখার একটি উপায় খুঁজে পেতে আমাদের সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন ট্রাম্প। যে কারণে আমি তাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।’

‘ট্রাম্প আমাদের যে সমর্থন দিয়েছেন, তাতে আমরা সন্তুষ্ট ও কৃতজ্ঞ। তিনি সত্যিকার অর্থে আমাদের প্ল্যাটফর্মটিকে বুঝতে পেরেছেন।’

যখন টিকটক বন্ধ হয়ে যায়, তখন ছোট্ট একটি বার্তা দেওয়া হয় যে, ‘দুঃখিত, টিকটক এখন বন্ধ আছে।’ পরে ট্রাম্পকে অন্তর্ভুক্ত করে মোটামুটি বড় একটি বার্তা দেওয়া হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় আইনে রবিবারের মধ্যে দেশটিতে টিকটক বন্ধ করতে বলা হয়েছিল। তবে ট্রাম্পের শপথের আগে আইনটি কার্যকর করার কোনো ইচ্ছা নেই বলে জানিয়েছিল বাইডেন প্রশাসন। এরপর প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা ও নিশ্চয়তা না পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক অচল করে দেয় বাইটড্যান্স।

তাদের এই অবস্থানকে ‘কপট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন ফিনার। এ বিষয়ে তার মত, ‘খোলাখুলিভাবে বললে, তাদের এই অনুভূতির মধ্যে কোনো সরলতা নেই। আমি মনে করি, আমরা খুবই পরিষ্কার—টিকটক বন্ধ করার দরকার ছিল না।’

জনপ্রিয় এই অ্যাপটির ওপর অনেক আগে থেকেই নজর পড়েছে বহু বিনিয়োগকারীর, যাদের মধ্যে রয়েছেন ট্রাম্পের সাবেক অর্থমন্ত্রী স্টিফেন মানুচিন ও ধনকুবের ব্যবসায়ী ফ্রাককোর্ট। তবে প্রতিবারই টিকটক বিক্রির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আসছে বাইটড্যান্স।

কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক পলিসি ইনস্টিটিউটের পরিচালক সারাহ ক্রেপস বলেন, ‘বাইটড্যান্স বিনিয়োগ ছেড়ে দেবে বলে মনে হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত এমন কোনো আভাস তাদের কাছ থেকে মিলছে না।’

আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রে বন্ধ হলো টিকটক